এক বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র গত কয়েকমাস যাবত্ সে লক্ষ্য করছে, তার চোখটা প্রায় হলুদ হলুদ দেখা যায় এবং প্রস্রাব গাঢ় হয়। বিষয়টি সে আগে খেয়াল করলেও অত গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু, ভার্সিটিতে ভর্তির পর কয়েকজন ক্লাসমেট তার জন্ডিস হয়েছে কি না জিজ্ঞাসা করলে সে ভালমত খেয়াল করতে শুরু করে। এরপর উদ্ব্বিগ্ন হয়ে সে বেশ কয়েকবার চিকিত্সকদের শরণাপন্ন হয়। চিকিত্সকরা প্রত্যেকবারই টেস্ট করার পর বলেন যে, তার ভাইরাল হেপাটাইটিস হয়নি। কিন্তু এরপরও কেন তার জন্ডিস হচ্ছে এ প্রশ্নের উত্তর খুজতে সে হাজির হয় লিভারের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের কাছে। চিকিত্সকের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে আবিদ বলে, যে চোখ হলুদ হওয়ার সমস্যাটা বেশী হয় যখন সে দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকে কিংবা খেলাধুলার পর ক্লান্ত অবস্থায় থাকে, তখন বমি বমি ভাব, জ্বর, ক্ষুদামন্দা এ ধরণের কোন লক্ষণও অনুভব হয় না। অতঃপর, কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চিকিত্সক আবিদকে বলে তার গিলবার্ট সিনড্রোম নামক একটি জন্মগত রোগ হয়েছে, যা জেনেটিক মিউটেশনের ফলে লিভারের একটি এনজাইমের ত্রুটির কারণে হয়। তিনি তাকে আশ্বস্ত করেন এই সমস্যাটি প্রকট নয় এবং এটি দীর্ঘমেয়াদে কোন জটিলতা তৈরী করবে না।
কি এই গিলবার্ট সিনড্রোম? এই ধরণের কি কি রোগ মানবদেহে হতে পারে? এই রোগগুলোর সাথে লিভারের অন্যান্য রোগের পার্থক্য কি? কেন এই রোগগুলো হয় এবং এগুলোর প্রতিকার কি? আলোচ্য প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে আমরা এই বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করবো।
হাইপারবিলিরুবিনেমিয়া ও জন্ডিস
মানুষের রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে গেলে চোখ ও ত্বক হলুদ হয়ে আসে এবং প্রস্রাব গাঢ় হলুদ বা লাল বর্ণ ধারণ করে। এ অবস্থাকে চিকিত্সাবিজ্ঞানের ভাষায় বলে জন্ডিস। জন্ডিস মূলত কোন রোগ নয়, রোগের লক্ষণ। জন্ডিস আক্রান্ত রোগীর রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা পরীক্ষা করলে তা বেশী পাওয়া যায়। রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেশী হওয়াকে বলা হয় হাইপার-বিলিরুবিনেমিয়া। একজন মানুষের রক্তে হাইপারবিলিরুবিনেমিয়া বিভিন্ন কারণে হতে পারে। কি কি কারণে হতে পারে জানার আগে চলুন আমরা জেনে নেই বিলিরুবিন কি?
আমরা জানি, আমাদের রক্তে বিভিন্ন ধরণের কণিকার মধ্যে লোহিত রক্ত কণিকা অন্যতম। লোহিত রক্ত কণিকার অন্যতম প্রধান কাজ হলো, ফুসফুস থেকে শরীরের অন্যান্য অঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহ করা। এই কাজটি মূলত সমপাদন করে লোহিত রক্ত কণিকার ভিতরে অবস্থিত হিমোগ্লোবিন নামক অণু। লোহিত রক্ত কণিকা তৈরী হয় অস্থিমজ্জায় (বোন ম্যারো) এবং তা রক্তে ১২০ দিন পর্যন্ত টিকে থাকে। এরপর এই রক্ত কণিকাগুলো প্লীহা ও লিভারের মাধ্যমে বিপাক হয়ে ভেঙ্গে যায় এবং কোষের উপাদানগুলোর কিছু পুনঃব্যবহারের জন্য রেখে দেয়া হয় এবং কিছু মল-মূত্রের মাধ্যমে পরিত্যক্ত হয়। হিমোগ্লোবিন অণুর বিপাকের ফলে তৈরী হয় বিলিরুবিন। লিভার কয়েকটি এনজাইমের মাধ্যমে বিলিরুবিনকে প্রক্রিয়াজাত করে। প্রক্রিয়াজাত বিলিরুবিন তৈরী হওয়ার পর লিভার কোষ তা পিত্তরসের সাথে ক্ষুদ্রান্ত্রে পৌছে দেয়। উক্ত প্রক্রিয়াজাত বিলিরুবিনের কিছু অংশ মলের সাথে বেরিয়ে যায় এবং কিছু অংশ রক্তে প্রবেশ করে ও কিডনীর মাধ্যমে মূত্রের সাথে বেরিয়ে যায়। মানুষের মল বা মূত্রের হালকা হলুদাভ রং-এর প্রধান কারণ এই প্রক্রিয়াজাত বিলিরুবিন।
কি কি কারণে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়
বিভিন্ন কারণে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। উপরে বর্ণিত বিলুিরুবিন বিপাক প্রক্রিয়ার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে রক্তে বিলিরুবিন বেড়ে যাবে যদি অধিক পরিমাণে লোহিত রক্তকণিকা ভেঙ্গে যায়, লিভারের প্রদাহ বা অন্যান্য রোগের কারণে বিলিরুবিন প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হয় এবং পিত্তনালী বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে প্রক্রিয়াজাত বিলিরুবিন ক্ষুদ্রান্তে নিঃসৃত না হতে পারে। আমাদের কাছে রোগীরা যে সকল কারণে জন্ডিস নিয়ে উপস্থিত হন তার মধ্যে প্রধান কারণ হলো, ভাইরাল হেপাটাইটিস জনিত লিভার প্রদাহ। এছাড়া অন্যান্য কিছু সাধারণ (কমন) কারণ হল-ডি-কমপেনসেটেড লিভার সিরোসিস, লিভার ফেইলিউর, পিত্তথলী ও পিত্তনালীর পাথর এবং পিত্তনালী ও প্যানক্রিয়াসের ক্যান্সার।
কনজেনিটাল হাইপারবিলিরুবিনেমিয়া
উপরোক্ত কারণগুলো ছাড়াও বিশেষ কিছু জন্মগত রোগের কারণে জন্ডিস দেখা দিতে পারে। লিভার কোষ যে এনজাইমের সহযোগিতায় প্রক্রিয়াজাত বিলিরুবিন তৈরী করে এবং যে অঙ্গাণুর সহযোগিতায় প্রক্রিয়াজাত বিলিরুবিনকে পিত্তনালীতে প্রেরণ করে জেনেটিক মিউটেশনের ফলে তাতে জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে। এই ক্ষেত্রে মানবদেহে যে রোগ হয় তাকে সাধারণভাবে কনজেনিটাল হাইপারবিলিরুবিনেমিয়া বলা যায়। কনজেনিটাল হাইপারবিলিরুবিনেমিয়ার অন্তর্গত রোগ মূলত চারটি; গিলবার্ট সিনড্রো, ক্রিগলার-ন্যাজার সিনড্রোম, ডুবিন-জনসন সিনড্রোম, রোটোর সিনড্রোম।
রক্তে কোন ধরণের বিলিরুবিন বাড়ছে তার উপর নির্ভর করে এদেরকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়- ডাইরেক্ট ও ইনডাইরেক্ট হাইপারবিলিরুবিনেমিয়া। ইনডাইরেক্ট হাইপারবিলিরুবিনেমিয়াতে লিভারে প্রক্রিয়াজাত হয়নি এমন বিলিরুবিনের পরিমাণ রক্তে বেড়ে যায়। এর মধ্যে আছে গিলবার্ট সিনড্রোম ও ক্রিগলার-ন্যাজার সিনড্রোম। ডাইরেক্ট হাইপারবিলিরুবিনেমিয়াতে প্রক্রিয়াজাত বিলিরুবিনের পরিমাণ রক্তে বেড়ে যায়। ডুবিন-জনসন সিনড্রোম এবং রোটোর সিনড্রোম ডাইরেক্ট হাইপারবিলিরুবিনেমিয়ার অন্তর্ভুক্ত। কনজেনিটাল হাইপারবিলিরুবিনেমিয়ার সাধারণ লক্ষণ হলো জন্ডিস। তবে রোগের প্রকারের উপর নির্ভর করে প্রস্রাব হলুদ হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। রোগীদের মধ্যে ভাইরাল হেপাটাইটিসজনিত লিভার প্রদাহের মত জ্বর, পেটে ব্যথা, ক্ষুধামন্দা, বমি ভাব ইত্যাদি পরিলক্ষিত হয় না। তবে হালকা দুর্বলতা ও পেটে অস্বস্তি হতে পারে।
No comments:
Post a Comment