Wednesday, November 25, 2015

বিশ্ব হোমিওপ্যাথির জাগরণ



৩৫টি দেশের ২৪০০ ডেলিগেটের অংশগ্রহণে ভারতের রাজধানী দিল্লীতে বিশ্ব হোমিওপ্যাথিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হল গত ১-৪ ডিসেম্বর আয়োজক সংস্থা ‘লিগা মেডিকোরাম হোমিওপ্যাথিকা ইন্টারন্যাশনালিস (Liga Medicorum Homoeopathica Internationals)। এটি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকদের বিশ্ব সংস্থা। ১৯২৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর এ সংস্থার জন্ম। জেনেভায় এর রেজিস্টার্ড অফিস। প্রথমে ৯টি দেশের প্রতিনিধি সমন্বয়ে এ সংস্থা গঠিত হয়, যার প্রথম সভাপতি ছিলেন আমেরিকান চিকিৎসক ডা. রয় উপহ্যাম (Dr. Roy Upham)। এ বিশ্ব হোমিওপ্যাথি সংস্থার ৬৬তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল ভারতে। আগামী বছর সেপ্টেম্বর মাসের ১৪-১৭ তারিখে জাপানে অনুষ্ঠিত হবে লিগার ৬৭তম সম্মেলন।
৬৬তম লিগা সম্মেলনটি ছিল বেশ জাকজমকপূর্ণ। সম্মেলনের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো Homoeopathy for Public Health. দিল্লীর বিলাসবহুল সিরিফোর্ট মিলনায়তনের ৪টি হলে একই সময়ে চারদিনব্যাপী এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ৩০০টি গবেষণাপত্র উপস্থাপিত হয়। বাংলাদেশ থেকে ডা. দেবাশীষ রানা তার গবেষণাপত্র উপস্থাপন করে বাংলাদেশের মর্যাদা রক্ষা করেন। যদিও বাংলাদেশের কৃতিসন্তান ডা. পরেশ চন্দ্র মোদক-এর গবেষণাপত্র সম্মেলনে গৃহীত হয়েছিল, কিন্তু তিনি অজ্ঞাত কারণে সম্মেলনে যাননি। এটি আমাদের জন্য একটি দুঃখজনক কারণ ছিল। সম্মেলনে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি বোর্ড-এর চেয়ারম্যান ডা. দিলীপ কুমার রায় উপস্থিত ছিলেন।
সম্মেলন উপলক্ষে ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রতিভা দেবীসিং পাতিল বাণী দিয়েছেন। এ বাণীতে তিনি বলেন, "Homoeopathy is a well-established, recognized and widely accepted system of medicine in India. It is safe and curative in chronic diseases. There is need to undertake organized research in Homoeopathy to make it a Prime public health system." এ সম্মেলন থেকে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা গবেষকরা ঘোষণা করেছেন যে, আগামী বিশ্বে হোমিওপ্যাথি ‘চিকিৎসা সুপার পাওয়ার' হিসেবে আবির্ভূত হবে।
সম্মেলন উপলক্ষে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল, যাতে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় হোমিওপ্যাথিক পুস্তক সংস্থা এবং ঔষধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো অংশগ্রহণ করে। প্রকাশনা সংস্থাগুলো তাদের আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বইগুলো প্রদর্শনীতে স্থান দেয়ায় চিকিৎসকরা উপকৃত হয়েছেন। বিশেষভাবে যারা গবেষণায় নিয়োজিত তারা এ সম্মেলন থেকে হোমিওপ্যাথির আধুনিক চিন্তাধারার প্রচুর বই সংগ্রহ করতে পেরেছেন। ভারতীয় সরকারি সংস্থা সেন্ট্রাল কাউন্সিল ফর রিসার্চ ইন হোমিওপ্যাথি (Central Council for Research in Homoeopathy) তাদের নানা ধরনের গবেষণা পুস্তক নিয়ে প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। তাদের ‘ক্লিনিক্যাল রিসার্চ স্টাডিজ' সিরিজের বইগুলো গবেষকদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। তাদের ডিজিজ মনোগ্রাফ (Disease Monograph) সিরিজের গুরুত্বপূর্ণ বই HIV/AIDS AND HOMOEOPATHIC MANAGEMENT এবং Diabetes Mellitus. যেখানে এইডস এবং ডায়াবেটিসের চিকিৎসা নিয়ে সারা বিশ্বে হতাশা বিরাজ করছে, সেখানে তাদের গবেষণায় দেখা গেছে যে, হোমিওপ্যাথিতে এ ধরনের দূরারোগ্য রোগের চিকিৎসা সম্ভব। হোমিওপ্যাথিক ড্রাগ প্রুভিংস নিয়েও সংস্থাটির রয়েছে সিরিজ প্রকাশনা, যা যে কোন হোমিওপ্যাথিক গবেষকের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। হোমিওপ্যাথিক ঔষধের ‘ক্লিনিক্যাল ভেরিফিকেশন' প্রকাশনা সিরিজটি আধুনিক হোমিওপ্যাথির জন্য একটি অনন্য অবদান। সংস্থাটির প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল "Homoeopathy for mother and child care' হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকদের মা ও ও শিশু চিকিৎসায় দক্ষতা অর্জনের এক অনন্য হাতিয়ার। আমরা যদি বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথি গবেষণায় এগিয়ে যেতে চাই তাহলে উল্লেখিত প্রকাশনাগুলো আমাদেরকে পথ দেখাবে। কারণ বিশ্বে একমাত্র উক্ত সংস্থাটিই হোমিওপ্যাথির আধুনিক গবেষণায় দিক-নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে।
লিগা সম্মেলনে উপস্থাপিত ৩০০টি গবেষণা পত্রের সবগুলোই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসায় যে সব রোগের সমাধান দিতে ব্যর্থ, সেসব ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথির সফলতার কথা উঠে এসেছে এসব গবেষণাপত্রে। যেমন, ক্যান্সার চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথির সফলতা নিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে অনেকগুলো ক্লিনিক্যাল স্টাডি রিপোর্ট, যার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, হোমিওপ্যাথি ঔষধ দ্বারা ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা সম্ভব। আন্তর্জাতিকভাবে উপস্থাপিত এ ধরনের গবেষণা কর্ম ক্যান্সার চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথির অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে।
যে সব চিকিৎসক দ্বিধাদ্বনদ্ব নিয়ে ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসায় অবতীর্ণ হতেন তাদের জন্য এসব গবেষণা পথপ্রদর্শকের কাজ করবে। আবার যারা বাণিজ্যিকভাবে ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা করতেন, তাদের জন্য অনেক সতর্ক বার্তা রয়েছে এসব গবেষণায়। কারণ একাডেমিক শিক্ষা এবং দক্ষতা না থাকলে যে ক্যান্সারের ন্যায় রোগের চিকিৎসা দেয়া যায় না তা ফুটে উঠেছে ঐসব গবেষণাপত্রে। আসলে এ ধরনের সম্মেলন চিকিৎসকদের দক্ষতা ও মান উন্নয়নে সহায়তা করে থাকে।
যক্ষ্মা বা টিবি চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথির সফলতা নিয়ে খুবই উন্নতমানের গবেষণাপত্র উপস্থাপিত হয়েছে লিগা সম্মেলনে। বিশেষভাবে ভারতের ডা: প্রবীন কুমারের উপস্থাপিত ‘‘An in vitro study on effect of Tuberculinum on genetic sequence of multidrug strains of mycobacteriwm tuberculosis’’ গবেষণা পত্রটি যে কোন যক্ষ্মা গবেষকের জন্য অনুসরণীয়। মানসিক রোগ এবং ড্রাগ আসক্তি নিরাময়ে হোমিওপ্যাথি ঔষধের সফলতার গল্পগুলো যে কোন মানুষের মনেই হোমিওপ্যাথি সম্পর্কে উন্নত ধারণা সৃষ্টি করবে। আর এ ধরনের অনেকগুলো গবেষণাপত্র স্থান পেয়েছে লিগা সম্মেলনে।
সবচেয়ে বড় খবর হচ্ছে, বাংলাদেশে নতুন রোগ বলে পরিচিত চিকনগুনিয়া (Chikungunia) নিয়ে দুর্দান্ত এক গবেষণাপত্র উপস্থাপিত হয়েছে লিগা সম্মেলনে। ভাইরাল কিভার বা চিকনগুনিয়ার প্রতিষেধক হিসেবে ‘‘ব্রায়োনিয়া’’ ঔষধটির ব্যবহার এ গবেষণায় প্রমাণ করা হয়েছে। চিকিৎসায় ঔষধ হিসেবে রাস টক্স (Rhus Tox) এবং  ইউপেটিরিয়াম পারপ (Eupatorium Purp) ঔষধ দু'টির কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে ক্লিনিক্যাল স্টাডি দ্বারা। ডেঙ্গু জ্বরে হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে ব্রাজিলের এক গবেষণাপত্রে। এভাবে এপিডেসিক ডিজিজে হোমিওপ্যাথি ঔষধের কার্যকারিতা ক্লিনিক্যাল স্টাডি দ্বারা প্রমাণিত হওয়ায় বিশ্ব দরবারে হোমিওপ্যাথির মর্যাদার আসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দাঁতের রোগের চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি ঔষধের ব্যবহার নিয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্র উপস্থাপিত হয়েছে। পশু চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি ঔষধের ব্যবহার নিয়ে যে সব গবেষণা স্থান পেয়েছে, তাতে দেখা যায় যে, হোমিওপ্যাথি ঔষধের আরেকটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।
চারদিনের লিগা সম্মেলনে অনেক নতুন নতুন তথ্য জানা গেছে। একটি গবেষণাপত্রে জানা গেছে যে, মানসম্পন্ন হোমিওপ্যাথি ঔষধ উৎপাদন খুবই ব্যয়বহুল। যেমন নোসোড গ্রুপের ঔষধ উৎপাদনে একটি জীবাণুর দাম ৫০ হাজার ইউরো। আর একটি ফার্মাসিউটিক্যাল তেলাপোকার দাম ১০-২০ হাজার ইউরো।
সম্মেলনের শেষ দিনে সব চিকিৎসকেরই মন খারাপ হয়েছে। বিশাল আয়োজন, বিশাল তথ্য ভান্ডার, বিশাল গবেষণাপত্রের এ সুন্দর আয়োজন আবার কবে হবে দক্ষিণ এশিয়ায় তা কে জানে। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম ভবিষ্যতের দক্ষিণ এশিয় লিগা সম্মেলনের জন্য।

No comments:

Post a Comment

কাঁচা মরিচের রয়েছে বিস্ময়কর স্বাস্থ্য উপকারিতা

তরকারিতে স্বাদ বাড়াতে কাঁচা মরিচের জুড়ি নেই। কেউ কেউ আবার খাবারের সময় অতিরিক্ত কাঁচা মরিচ নিয়ে রুচিসহকারে খেতে থাকেন। তাঁদের জন্য আরও সুখ...